বিদ্রোহের মহানায়ক হাবিলদার রজব আলী

বিপ্লব-তীর্থ চট্টগ্রাম হাজারো বিপ্লবীদের জন্মভূমি। এই চট্টগ্রামকে বলা হয় হাবিলদার রজব আলীর চট্টগ্রাম, মাস্টারদা সূর্যসেনের চট্টগ্রাম, প্রীতিলতার চট্টগ্রাম, কাজেম আলী মাস্টারের চট্টগ্রাম,
মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর চট্টগ্রাম, রাজনীতিক এম এ হান্নান, মান্নান, জহুর আহমেদ, এম এ আজিজ-এর চট্টগ্রাম। এই চট্টগ্রাম বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী মহাকবি আলাওলের চট্টগ্রাম, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের চট্টগ্রাম, মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের চট্টগ্রাম।

১৮৫৭ সালের চট্টগ্রামে সিপাহী বিদ্রোহের মহানায়ক হাবিলদার রজব আলীকে স্মরণ করে বাংলা কবি মোহিনী চৌধুরী ১৯২০ সালে রচনা করে তাঁর বিখ্যাত কালজয়ী কবিতা:
“মুক্তির মন্দির সোপান তলে
কত প্রাণ হল বলিদান
লেখা আছে অশ্রু জলে।”
এরকম শত শত সাহিত্যিক কবিগণ ভারতীয় উপমহাদেশের চট্টগ্রামকে নিয়ে কালজয়ী গান, কবিতা, সাহিত্য রচনা করেছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেরই একজন বিপ্লবী বীর যোদ্ধা হাবিলদার রজব আলী।


হাবিলদার রজব আলী খাঁ চট্টগ্রামের ইতিহাসে গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তি। তিনি ১৯ শতকের জন্ম নেয়া যোদ্ধা। তাঁর জন্ম পরিচয় এখনো অজ্ঞাত, কবে এবং কোথায় মৃত্যুবরণ করেন তাও অজানা। ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষে সিপাহী বিদ্রোহে তাঁর অগ্রণী ভূমিকার কারণে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।
১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরবর্তীতে সমগ্র ভারতবর্ষ ইংরেজদের করতলগত হয়।
ভারতবর্ষ ছিল অপার সম্পদে সমৃদ্ধ, ইংরেজরা ছলে বলে কৌশলে এদেশ দখলের পর এর সম্পদ পাচার করে ইংল্যান্ডে, এদেশবাসীর ওপর অব্যাহত নির্যাতন চালায়। এদেশীয় ক্ষুদ ক্ষুদ্র রাজ্যের নবাব ও রাজা মহারাজাদের ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, বনেদি পরিবারগুলো নিঃশেষ হয়ে যায়। হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টি করে ইংরেজ ভারতবাসীর হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি করে। অচিরেই ভারতবাসী তা বুঝতে পারে এবং বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র আকারে হলেও আন্দোলন সংগ্রামে নেমে পড়ে। ক্রমে তা বৃহৎ আকার ধারণ করে।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে স্বাধীনতা হারানোর মর্মবেদনা ভুলতে পারেনি স্বাধীনতাকামী ভারতবাসী । এর শত বছর পর ১৮৫৭ সালে পরিকল্পিতভাবে সংগ্রাম শুরু হয়। প্রথমে পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে ও পরবর্তীতে ব্যারাকপুরে দেশি সিপাহীদের ছাউনিতে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। সিপাহী বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে কানপুর, মীরাট হয়ে সমগ্র উত্তর ও মধ্য প্রদেশে।


বিদ্রোহীরা দিল্লী দখল করে ভারতের মোগল বংশের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে (দ্বিতীয়)সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেয় ও তার নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ চালায়। প্রথমদিকে ব্যাপক সাফল্য আসলেও পরবর্তীতে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে যায়। স্বয়ং সম্রাট বাহাদুর শাহ বন্দী হন ও তাঁকে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেয়া হয়। রাজপরিবারের শাহজাহাদাদের হত্যা করা হয়।

সে বছর নভেম্বর মাসে সুদূর চট্টগ্রামের দেশীয় সিপাহীরা হাবিলদার রজব আলী খাঁ’র নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। চট্টগ্রামে অবস্থান করতো ৩৪ নম্বর দেশীয় পদাতিক বাহিনীর ২,৩ ও ৪ নম্বর কোম্পানি। ১৮ নভেম্বর (কারও মতে ১২ নভেম্বর, অবশ্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বাৎসরিক ডাইরীতে ১২ নভেম্বর ব্রিটিশ সিপাহী বিপ্লবের কথা উল্লেখ আছে) দেশীয় সিপাহীরা হাবিলদার রজন আলী খাঁ’র নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। ইতিপূর্বে কলকাতার ব্যারাকপুরে ও বহরমপুরের কোথাও সংঘবদ্ধ অভ্যুত্থান হয়নি কিন্তু চট্টগ্রামে হয়েছে।

এদিন রাত ৯টার দিকে বিদ্রোহীরা গুলি ছুঁড়ে বিদ্রোহ করে। জেলের তালা ভেঙে কয়েদীদের মুক্ত করে। সিপাহীরা আন্দরকিল্লা জামে মসজিদে অবস্থান নেয়। এদিকে ব্রিটিশরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে সমুদ্রে জাহাজে আশ্রয় দেয়। চট্টগ্রাম প্রায় ত্রিশ ঘণ্টা ব্রিটিশ শাসনমুক্ত ছিল।

১৯ নভেম্বর শেষ রাতে সিপাহীরা পিলখানা থেকে হাতি নিয়ে সদলবলে চট্টগ্রাম শহর ত্যাগ করে। এই বিদ্রোহের সময় গুলি বিনিময়কালে একাধিক সিপাহীর মৃত্যু হয়। যাদের কবর দেয়া হয় আনন্দকিল্লা জামে মসজিদের আঙ্গিনায়। পরবর্তীতে মসজিদের সম্প্রসারণকালে এই কবরগুলো ভেঙে ফেলা হয়।


বিদ্রোহীরা চট্টগ্রাম ত্যাগ করে উত্তর দিকে চলে যায়। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল ঢাকায় অবস্থানরত ৭৩ নম্বর দেশীয় পদাতিক বাহিনীর সাথে যোগ দেয়া। কিন্তু তার আগেই ঢাকায় অবস্থানরত সিপাহীদের অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়। বহু সিপাহীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।
এদিকে চট্টগ্রামের সিপাহীরা স্থানে স্থানে বাধার সম্মুখীন হয়ে ত্রিপুরা হয়ে মনিপুরের জঙ্গলে চলে যায়। দীর্ঘ যাত্রাপথে একের পর এক যুদ্ধ, খাদ্যাভাব ও অসুস্থতার কারণে ধ্বংস হয়ে যায় চার’শ সিপাহীর এই দেশপ্রেমিক বাহিনী।


চট্টগ্রামে সিপাহী বিদ্রোহের মহানায়ক হাবিলদার রজব আলী খা’র কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তিনি চট্টগ্রামের অধিবাসী কিনা তাও অজানা। তবে অনেক ইতিহাস গবেষক ও বিশ্লেষকদের মতে, হাবিলদার রজব আলী সন্দ্বীপের আবার, কারো মতে তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের হাইদগাঁও কিংবা আরো কয়েকজন গবেষকের মতে লোহাগাড়া এর চক্রশালা চট্টগ্রাম-এর অধিবাসী। যেখানেই তার জন্ম হোক আর মৃত্যু হোক তিনি চট্টগ্রামের বিপ্লবী বীর হিসেবে সম্মানিত।