আমাদের মুক্তিযুদ্ধে দেশের অনেক সাহসী বীরই জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে গেছেন। প্রাণের ভয় তাঁদের ছিলো না মোটেই। তাঁদের সেই মহান আত্মত্যাগের কারণেই আজ আমরা পৃথিবীর বুকে এক স্বাধীন জাতি। আমরা পারি আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারি, আমরা পারি আমাদেরকে বাংলাদেশী হিসেবে পরিচয় দিতে। কিন্তু আমাদের এই দেশকে স্বাধীন করতে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী
যুদ্ধ করতে হয়েছে। পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হয়েছে সশস্ত্র প্রতিরোধ। আমাদের দেশের এই মুক্তির যুদ্ধে আমরা অনেক বিদেশী মানুষকেও সঙ্গী হিসেবে পাশে পেয়েছি। যাঁরা এই দেশের মানুষ না হয়েও আমাদের এই দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করেছিলেন। সে সময় বাঙালীদের উপরে পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার তাঁরা সহ্য করতে পারেননি। এই অত্যাচারের হাত থেকে বাঙালী জাতিকে বাঁচাতে তাঁরাও এগিয়ে এসেছিলেন গভীর মমতায়। সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শনের কারণে একজন ভিনদেশি মানুষের নাম আমাদের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাঁর নাম ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড। যেন নতুন করে জাগিয়ে তোলে। রক্তের ভেতর আবার সেই পুরোনো ডাক অনুভব করেন তিনি যুদ্ধে যাওয়ার। বহুজাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্তা ৫৪ বছর বয়সী ওডারল্যান্ড আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন যোদ্ধার ভূমিকায়।
ওডারল্যান্ড ১৯১৭ সালে নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি লড়েছিলেন ডাচ বাহিনীর পক্ষে। এর জন্য তাঁকে নাৎসী বাহিনীর বর্বরতার শিকার হতে হয়েছিলো। সে অবশ্য আরেক ইতিহাস, অন্য কোনোদিন জানবো। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকার অদূরে টঙ্গীতে বাটা স্যু কোম্পানীতে কর্মরত ছিলেন। পঁচিশে মার্চের কালরাতে নিরীহ বাঙালীর উপরে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা তাকে যথেষ্টই মর্মাহত করে। হবে নাই বা কেন, তিনি তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নির্যাতিতদের পক্ষেই যুদ্ধ করেছিলেন। মনে মনে তাঁর ক্ষোভ জন্ম নেয়। তিনি জড়িয়ে পড়েন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে।
যে কোনো কারণেই হোক ওডারল্যান্ড তাঁর জীবদ্দশায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতিচারণ করেননি। তবে তাঁর কিছু ডায়েরি এবং চিঠিপত্রে বেশ কিছু অজানা তথ্য পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, পাকিস্তানীদের বর্বরতা তাঁর যৌবনের ইউরোপের স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছিলো। তাঁর চোখে তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এক হয়ে যায়। তাঁর মনে হয়েছিলো, এই বর্বরতার কথা বিশ্বকে জানানো উচিত। ব্যক্তিগতভাবে যেহেতু তিনি বিদেশী, সেহেতু কোথাও চলাফেরা করতে তাঁর কোনো সমস্যা হচ্ছিলো না। আর তাই সেসময়ের নানা ছবি তুলে তিনি পাঠিয়েছিলেন বিদেশের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে। এর ফলেই বিশ্ববাসী জানতে পেরেছিলো তৎকালীন বাংলাদেশের অবস্থা।
শুধু এটুকু কাজ করেই তিনি ক্ষান্ত দেননি। পাকিস্তানী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে গোপন তথ্য তিনি মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিতেন। আর যুদ্ধকালীন সময়ে এসব গোপন তথ্য অনেক গুরুত্ব বহন করে। গোপন তথ্যের ভিত্তিতেই পরিকল্পনা তৈরি করা হয় যে কিভাবে শত্রুকে ঘায়েল করতে হবে। এ কারণেই ওডারল্যান্ডের দেয়া গোপন তথ্য অনেক কাজে লেগেছিলো।
এরপরও তিনি বসে থাকলেন না। জড়িয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধের আরো গভীরে। ভিতরে ভিতরে অনুভব করতে পেরেছিলেন যে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। কাজেই আর দেরি কেন! ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধে। প্রথমে তিনি বাটা'র শ্রমিকদেরকে সক্সঘবদ্ধ করলেন। নিজেই দিলেন প্রশিক্ষণ। কারণ তাঁর তো সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রশিক্ষণ রয়েছেই। তারপর টঙ্গীসহ সেক্টর ১ এবং সেক্টর ২ এ গড়ে তোলেন গেরিলা বাহিনী। গেরিলা বাহিনী কি জানো তো? যাঁরা যুদ্ধের সময় অতর্কিতে হামলা চালিয়ে শত্রুর সবকিছু ধ্বংস করে দেয় তাদের বলে গেরিলা বাহিনী। ওডারল্যান্ড এই গেরিলা বাহিনী বানিয়ে শুরু করলেন সম্মুখ যুদ্ধ। সম্মুখ যুদ্ধে যখন তখন প্রাণ যেতে পারে। কিন্তু ওডারল্যান্ড একজন বিদেশী হয়েও তার প্রাণের কোনো মায়া করেননি। তাঁর এই বীরত্বের জন্য পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে 'বীর প্রতীক' উপাধিতে ভূষিত করেন।
ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড একমাত্র ভিনদেশি যিনি বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের একদম সম্মুখে ছিলেন। তিনি আমাদের দেশের একমাত্র ভিনদেশি 'বীর প্রতীক'। অস্ট্রেলিয়াতে ২০০১ সালের ১৮ মে তিনি মারা যান। কিন্তু শেষদিন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করেছেন। আর এই ভালোবাসার কারণেই তিনি যুদ্ধে জড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের হয়ে। তাঁর প্রতি আমাদের জাতির অনেক ঋণ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এই ভিনদেশি বীরকে আমরা স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায়