মার্টিন লুথার কিং বা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র একজন আফ্রিকান-আমেরিকান মানবাধিকার কর্মী। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর ইতিহাসে যে সব ব্যক্তি নির্যাতিত, অত্যাচারিত নিপীড়িত আর অধিকার বঞ্চিত মানুষদের জন্যে সংগ্রাম করে গেছেন, সেই সংগ্রামে নিজের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছেন মার্টিন লুথার কিং তাদের মধ্যে অন্যতম। মার্টিন লুথার কিং ই প্রথম মানুষ যে আমেরিকায় কালো মানুষদের প্রতি বৈষম্যের জন্যে প্রতিবাদ শুরু করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নির্যাতিত মানুষের জন্যে লড়াই করে গেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার জর্জিয়ায় ১৫ই জানুয়ারি, ১৯২৯ জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মার্টিন লুথার কিং সিনিয়র এবং মা আলবার্ট উইলিয়ামস কিং। জন্মের সময় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল মাইকেল লুথার কিং, পরবর্তীতে কিশোর বয়সে এই নাম পালটে তিনি নিজেই বাবার নামানুসারে তার নতুন নাম রাখেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। তিনি ছিলেন একাধারে আমেরিকান ব্যাপটিস্ট মন্ত্রী,মানবাধিকার কর্মীএ,বং আফ্রিকান-আমেরিকান সিভিল রাইটস মুভমেন্ট এর নেতা। তিনি তার খৃস্টান বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে নাগরিক অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকার জন্য বেশি পরিচিত। তিনি ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি হতে আমৃত্যু আমেরিকার সিভিল রাইট মুভমেন্ট এর নেতা হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল একজন শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থী যুবক জেমস আর্ল রে দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
শিক্ষাজীবন:মার্টিন লুথার কিং যে কোন এলেবেলে ধরনের ছেলে ছিলেন না, তা তাঁর কিশোর বয়স থেকেই বুঝা গিয়েছিল। তার যখন ৬ বছর বয়স তখন মার্টিন লুথার কিং এর সাথে এক সাদা বালকের বন্ধুত্ব হয় যার বাবা ছিল একজন ব্যবসায়ী। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হবার পর তার বাবা আর তাকে কিং এর সাথে মিশতে দেয়নি। এজন্য কিং মানসিকভাবে খুবই হতাশ ছিলেন। আটলান্টার বুকার টি ওয়াশিংটন হাইস্কুলে তার স্কুল জীবন শুরু। কালো চামড়ার ছিলেন বলে তাকে কালোদের জন্য নির্দিষ্ট স্কুলে তাকে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি এতটাই মেধাবী ছিলেন যে তাকে ক্লাস নাইন ও ক্লাস টুয়েলভ পড়তেই হয়নি। দুইবার অটো-প্রমোশন পেয়ে ১৯৪৮ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে মোর-হাউজ কলেজ থেকে সমাজ বিজ্ঞান এর উপর স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর ১৯৫৫ সালে বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে দর্শন শাস্ত্রে পিএইচডি, ডক্টর অব ফিলোসোফি ডিগ্রি লাভ করেন।
লুথার কিং এর সংগ্রামী কর্মজীবন:কর্মজীবনের শুরুতে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র মানবাধিকার কর্মী ছিলেন। নাগরিক অধিকার রক্ষাই তার উদ্দেশ্য ছিল। আমেরিকার সিভিল রাইট নেতা হাওয়ার্ডস থমসন এবং ভারতের নন ভায়োলেন্স এর জনক মহাত্মা গান্ধীর মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিং অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে আমৃত্যু এই সংগঠনটির নেতৃত্ব দিয়েছেন। গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ তাঁকে খুব বেশী অনুপ্রাণিত করেছিল। লুথার কিং গান্ধীজীর সত্যাগ্রহে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৫৯ সালে গান্ধীর জন্মস্থান ভারত সফর করেন। ১৯৫৭ সালে রেফ এবারনেথি এবং অন্যান্য সিভিল রাইট নেতাদের সহযোগিতায় স্থাপন করেন সাউদার্ন লিডারশীপ কনফারেন্স। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তাদের নৈতিক চরিত্র গঠন নিশ্চিত করাও ছিল এই সংগঠনটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রই প্রথম মানুষ যে আমেরিকায় কালো মানুষদের প্রতি বৈষম্যের জন্যে প্রতিবাদ শুরু করেন। একটা সময় আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের সাথে চরম বৈষম্য করা হতো। সাদা মানুষ বাসে উঠলে কালো মানুষদের সিট ছেড়ে দিতে হত। মূলত এই ইস্যুকে কেন্দ্র করেই তার সত্যিকারের সিভিল রাইট মুভমেন্ট শুরু হয় ১৯৫৫ সালে। ১৯৫৫ সালের ১লি ডিসেম্বর তারিখে মিসেস রোজা পার্কস নামের আফ্রিকান-আমেরিকান এক ভদ্র মহিলা বাসে শ্বেতাঙ্গ মানুষকে সিট ছেড়ে না দেওয়াতে তাকে গ্রেফতার করে হাজতে নিয়ে যায় পুলিশ। এই ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে তারা মন্টোগমারীতে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। মার্টিন মহাত্মা গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের প্রক্রিয়া সমর্থন করে ঐ বাস সার্ভিস সমস্ত কালোদের জন্য বয়কটের সিদ্ধান্ত নেন। এতে বাসে না চড়ে পায়ে হেঁটে, কেউবা নিজের গাড়ী চালিয়ে অফিসে যাওয়া আসা করতে থাকেন। এভাবে চলে ৩৮১ দিন। ফলে আলবামা শহরে বাসে বর্ণ ভেদাভেদ নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক মুক্তি, চাকরির সমতা অর্জন এবং সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লুথার কিং, বেয়ারড রাস্তিন এবং আরও ছয়টি সংগঠনের সহায়তায় মার্চ অন ওয়াশিংটন ফর জব এন্ড ফ্রিডম (March On Washington for Job and Freedom.) নামে এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেন। এই সমাবেশটি ছিলো আমেরিকার ইতিহাসে সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ মহা-সমাবেশ। এই সমাবেশে যোগ দেবার জন্য অসংখ্য মানুষ ২০০০ টি বাস, ২১ টি স্পেশাল ট্রেন, ১০ টি এয়ারলাইন্স এর সকল ফ্লাইট ও অসংখ্য গাড়িতে করে ওয়াশিংটনে এসেছিল। সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল লিঙ্কন মেমোরিয়ালে। প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের সমাবেশ হয়েছিল ঐ মহা-সমাবেশে। “I Have a Dream”('আই হ্যাভ এ ড্রিম') নামে লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে দেয়া সেই বিখ্যাত ভাষণ বিশ্বের সর্বকালের সেরা বাগ্মিতার দৃষ্টান্তগুলোর অন্যতম হয়ে আছে। সেই সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন দশ জন, তার মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন জন লুইস – মার্টিন লুথার কিং য়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধের তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। ছিলেন দারিদ্র্যমুক্তি আন্দোলনের নেতা। আজ বিশ্বে তাঁর স্থান মানবাধিকারের কিংবদন্তি হিসেবে। সবচেয়ে কম বয়সে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্মান তাঁরই। অমর তাঁর মহান সংগ্রাম। একইভাবে অমর তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতা ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’।
ধর্মীয় বিশ্বাস: