আব্রাহাম লিংকন - Abraham Lincoln

  
রাজনৈতিক যেসব নেতা বিভিন্ন সময় তাঁদের কার্যকলাপের জন্য ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছেন আব্রাহাম লিংকনতাঁদের মধ্যে অন্যতম।১৮৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম এবং রিপাবলিকান পার্টির প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে ১৮৬১ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। মাত্র তিন মিনিটে ২৭২ শব্দের এক ভাষণ দিয়ে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষোড়শ রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন। 

দাস প্রথাকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের সময় তিনি উত্তরাঞ্চলীয় ইউনিয়ন বাহিনীর নেতৃত্ব দেন, এবং দক্ষিণের কনফেডারেট জোটকে পরাজিত করেন। দাস প্রথার চরম বিরোধী লিংকন ১৮৬৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাস প্রথার অবসান ঘটান এবং মুক্তি ঘোষণার মাধ্যমে দাসদের মুক্ত করে দেন। ১৮৬৫ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।


আব্রাহাম লিংকন ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যের হার্ডিন কাউন্টিতে জন্মগ্রহণ করেন। থমাস লিংকন ও ন্যান্সি লিংকন দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান আব্রাহাম। শিশুকালেই লিংকন তাঁর মা ন্যান্সি হ্যাংকসকে হারান। পরের বছরই তাঁর বাবা সারাহ বুশ জনস্টন নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। ছোটবেলায় তিনি তার বন্ধুদের জড়ো করে উঁচু এক স্থানে উঠে বক্তব্য রাখতেন। 

এক বছরেরও কম সময় বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন লিংকন তবে ছোট থেকেই তিনি বই পড়তে খুব ভালোবাসতেন। বই পড়তে ভালোবাসলেও আর্থিক অনটনে সেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হয়ে ওঠেনি তার। নিজের চেষ্টায় আইনশাস্ত্র আয়ত্ত করেন এবং শেক্সপিয়ারের লেখা পড়ে ভাষাগত দক্ষতা গড়ে তোলেন। তিনি তার মূল শক্তি ভাষার প্রয়োগ কে তার নিজ অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজের স্বার্থ নয়, বরং আমেরিকান মানুষদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি মহান হতে পেরেছিলেন। ইলিনয়ে আইনজীবী হিসেবে কাজ করার সময়, লিংকন প্রায়শই সন্ধ্যায় একটি পানশালায় তার বন্ধুদের সাথে দেখা করে গল্প বলা প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতেন। ১৮৪২ সালে আব্রাহাম লিংকন মেরি টডকে বিয়ে করেন। তাঁরা চার সন্তানের জন্ম দিলেও মাত্র একজনই ১৮ বছরের বেশি বেঁচেছিলেন।


মাত্র ২৩ বছর বয়সে রাজনীতিতে তার অভিষেক হয় নির্বাচনে পরাজয়ের মাধ্যমে। কিন্তু ক্যারিশমা ও নিজের নীতির কারণে ক্রমেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি তার কথার শক্তি দিয়ে তার প্রতিপক্ষদেরকে কাবু করে ফেলার ক্ষমতা রাখেন এবং তিনি তাদের প্রতি কড়া সমালোচনা ছুঁড়ে দিলেন। ১৮৪০ সালে এক রাজনৈতিক সভায় তিনি তার প্রতিপক্ষ লেস থোমাসের নকল করে তাকে মজা করেছিলেন যা দর্শকরা তুমুলভাবে করতালি দিয়ে স্বাগত জানায়। ১৮৬০ সালে রিপাবলিকান পার্টির টিকিটে নির্বাচিত হয়ে ১৮৬১ সালের ৪ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন লিংকন। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে প্রেসিডেন্ট হওয়ার মধ্যেই তার কৃতিত্ব সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রেসিডেন্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ সঙ্কট সফলভাবে সামাল দেন তিনি। 

১৮৬৩ সালের ১ থেকে ৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়ার গেটিসবার্গে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে প্রায় আট হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। গৃহযুদ্ধের সময় এক ধর্মযাজক কথা প্রসঙ্গে তাঁকে বলেছিলেন, ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আসুন, আমরা বিশ্বাস রাখি এবং প্রার্থনা করি যে এই দুঃসময়ে ঈশ্বর আমাদের পক্ষে থাকবেন।’ প্রতি-উত্তরে লিংকন বললেন, ‘ঈশ্বর নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই। কারণ আমি জানি যে ঈশ্বর সব সময় ন্যায় ও সত্যের পক্ষেই থাকেন। এর চেয়ে বরং আসুন, আমরা প্রার্থনা করি, এই জাতিটা যেন সব সময় ঈশ্বরের পক্ষে থাকতে পারে। 

লিংকন শত্রু সহ অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং প্রতিকূল পরিবেশে তিনি তার এই শক্তিকেই কাজে লাগাতেন। আমেরিকাকে শাসন করার জন্য এই গুণ তার মধ্যে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ তখন আমেরিকা ছিল এক বিভক্ত জাতি যে সবেমাত্র গৃহ যুদ্ধ কাটিয়ে উঠেছিল। একবার তিনি আর তার স্ত্রী ম্যারি টড ওয়াশিংটনে আসলে তার স্ত্রী বলেন, এখানে তো শুধু শত্রু আর শত্রু, জবাবে লিংকন বলেন, শত্রু বলে কিছু নেই। দক্ষিণ আমেরিকানদের ব্যাপারে তিনি বলেছিলেনঃ “তাদের জায়গায় আমরা থাকলেও তাদের মতই করতাম। তাদের মধ্যে দাস প্রথা বিরাজমান ছিল বলে তারাই এর প্রচলন করে।” তার কথার শক্তি বোঝা যায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার ভাষণে যেখানে তিনি বলেন, “আমরা কারো শত্রু নই, আমরা সবাই বন্ধু। আন্তরিকতায় ব্যাঘাত ঘটলেও তা যেন সম্পর্কের বন্ধনকে ছিন্ন না করে।” 


১৮৬৩ সালের জুলাই মাসের যুদ্ধের প্রায় চার মাস পর ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর পেনসিলভেনিয়ার গেটিসবার্গে শহীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে এক স্মরণসভায় সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন লিংকন। বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফটোসাংবাদিক এবং ফটোগ্রাফাররা ঠিকমতো ক্যামেরা সেট করার আগেই মাত্র তিন মিনিটে ২৭২ শব্দের বক্তৃতা শেষ করেন লিংকন। এই ভাষণে তাঁর দেওয়া গণতন্ত্রের সংজ্ঞা যেন এক কালজয়ী মহাকাব্য। বক্তব্যের শুরুতে তিনি স্মরণ করেন তার পূর্ব-পুরুষদের, যারা ৪৭ বছর আগে স্বাধীনতা ও সবার মাঝে সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমেরিকা মহাদেশের গোড়াপত্তন করেন। মাঝে তার কণ্ঠে ফুটে ওঠে গৃহযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির করুণ আর্তনাদ। আর বক্তৃতা শেষ করেন এক ঐতিহাসিক উক্তি দিয়ে যা পৃথিবী থেকে কখনো হারিয়ে যাবে না। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, Government of the People, by the People, for the People "জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার এবং জনগণের জন্য সরকার" যা গণতন্ত্রের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা হিসেবে আজও বিবেচিত। এই বক্তৃতার পর বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন উপস্থিত জনতা। এমনকি হাততালি দিতেও ভুলে যান তারা। 


১৮৬৫ সালের ১৫ এপ্রিল রাজধানী ওয়াশিংটনের ফোর্ড থিয়েটারে নাটক দেখার সময় জন উইকস বোথ নামের এক রাজনৈতিক কর্মীর গুলিতে নিহত হন ইতিহাসের এই অমর বক্তা। লিংকনের মাথার পেছনে গুলি করে পালিয়ে যান উইলকস। তিনিই খুনের শিকার হওয়া প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এর ১২ দিন পর ২৬ এপ্রিল ভার্জিনিয়ার উত্তরাঞ্চলের একটি খামারের গোলাঘরে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিয়ন সেনা বাহিনীর সার্জেন্ট বস্টন কর্বেটের গুলিতে নিহত হন লিংকনের হত্যাকারী জন উইলিকস বুথ। লিংকনের মৃত্যুর দেড়শ বছর পরও রাজনীতি বিজ্ঞানের গবেষকরা বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন গণতন্ত্রের মোক্ষম সংজ্ঞা দাতা আব্রাহাম লিংকনকে।