কার্ল মার্ক্স

কার্ল মার্কস ছিলেন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ; মনীষাপ্রসূত এক বিপ্লবী তত্ত্ববিশ্বে তাঁর এই প্রভাব অতিক্রমনীয়- এতে সন্দেহ নেই সহৃদয়চিত্ত এই বিপ্লবী ভাবুকের জন্ম হয় ১৮১৮ সালে, মে; জার্মানি তথা প্রুশিয়ার রাইন অঞ্চল-ট্রিয়ার শহরে রাইনের এই বাম উপকূল এক সময় যুক্ত হয়ে পড়েছিল ফ্রান্সের সঙ্গে ফ্রান্সের জন্য এই সময়টা ছিল তখন সাম্য, মৈত্রী স্বাধীনতার; বিপ্লবের প্রস্তুতিপর্বের সঙ্গে তুলনীয় যেমন, একই সাথে সেটা ছিল তেমনি আলোকায়নেরও যুগ পরবর্তীতে এই রাইন ১৮১৫ সালে নেপোলিয়ন সা¤্রাজ্যের পতনের মধ্যদিয়ে আবার প্রুশিয়ার হাতে আসলে আলোকায়নের সেই প্রভাব কিন্তু থেকেই যায় আলোকায়নের এই প্রভাব এর সারগ্রাহী উত্তরাধিকারের মধ্যেই জন্ম হয় বিপ্লবী এই মনীষী-কার্ল মার্কসের


কার্ল মার্কসের পিতা হেনরিখ মার্কস ছিলেন ফরাসি এই আলোকায়ন পর্বের সন্তান; পূজারি তো বটেই, সেই সাথে এই ভাবাদর্শেরও একজন নিবিষ্ট অনুরাগী বাস্তবিক কারণেই তখন গৃহের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়তো তাঁর সেই অনুরাগের ছাপ এই ছাপের অর্থ হলো ব্যক্তিগত প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যদিয়ে আলোকায়নের সেই বুদ্ধিমত্ত্বাকে অন্বেষণ করা শুধু তাই নয়, হেনরিখের কাছে এই প্রভাব ছিল এমনই- ট্রিয়ারের দিনগুলোতে যা থাকে প্ররোচিত করতো নিরেট একজন ফরাসি ভদ্রলোক হয়ে উঠতে তখন আইনজীবী পিতা হেনরিখের সঙ্গে মার্কসের মা হেনরিয়েটা ছিলেন রীতিমতো বড়সড় এই পরিবারের একজন দক্ষ ম্যানেজার রুচিশীল এই আলোকিত দাম্পতির সন্তানাদির মধ্যে ছিল চার পুত্র পাঁচ কন্যা বড় ছেলে ডেভিডের মৃত্যু হলে তাঁদের এই পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র হয়ে উঠেনকার্ল’- কার্ল মার্কস; ‘পিতা-মাতার আশা-ভরসা প্রিয়পাত্র

এখানে বেড়ে ওঠার এই সময়কাল জুড়ে পিতা হেনরিখের প্রভাব যতটা না ছিল, তারচেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না তাঁর স্কুলের সহপাঠী বন্ধু এডগার আর বোন সোফিয়ার বান্ধবী- জেনির পিতা ল্যুডভিগ ভন ভস্টফালেনের প্রভাব মার্কসদের পরিবারটি তখন সমৃদ্ধ সংস্কৃতবান ছিল- সন্দেহ নেই; কিন্তু বিপ্লবী ছিল না অপরদিকে ভস্টফালেনের পরিবার ছিল যুগপৎভাবে সমান সমৃদ্ধ অধিক অগ্রসর এবং অবশ্যই বিপ্লবী পরিবার এই ভস্টফালেন পরিবারে মার্কসের যাওয়া-আসার সুবাদে তখন ছোট মার্কস আর বুড়োও পরবর্তীতে তাঁর শ্বশুর ল্যুডভিগ এর মধ্যে গড়ে ওঠেছিল বুদ্ধিবৃত্তিক এক সম্পর্ক এই সম্পর্কসূত্রই মার্কসের সামনে প্রথমবারের মতো দ্বারোদ্ঘাটন পরিচয় করিয়ে দেয় ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রী তথা সাঁ সিঁমোর রচনাবলির সঙ্গে বস্তুত এখান থেকেই নির্দিষ্ট হয়ে যায় মার্কসের মানবিক বিশ্ব রচনার লক্ষ্য


মার্কস ট্রিয়ারের মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশোনা করেন ১৮৩০ থেকে ১৮৩৫ পর্যন্ত; তারপর বন থেকে তিনি যান বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখানেই মার্কস পড়েন আইনশাস্ত্র; ‘কিন্তু বিশেষ করে অধ্যয়ন করেন ইতিহাস দর্শন ১৮৪১ সালে তিনি জেনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন কিছুদিন তিনি কলউনের (Cologne) একটি উদারপন্থী সংবাদপত্রে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন পরে, ১৮৪১ সালে সস্ত্রীক প্রগতিশীলতার লালনভুমি প্যারিস গমন করেন সেখানে তিনি একজন বিপ্লবী কম্যুনিস্ট হয়ে ওঠেন এবং তাঁর আজীবন সহযোগী ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন ফ্রান্স থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তিনি দুই বছর ব্রাসেল্সে অবস্থান করেন এখানে এঙ্গেলসের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হয় তারা যৌথভাবে রচনা করেন 'কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো' যা প্রকাশিত হয় ১৮৪৮ সালে এতে দাবি করা হয় যে, আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাসই শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস* তবে প্রলেতারিয়েতের** বিজয়ের মধ্য দিয়েই এর চরম বিনাশ ঘটবে ১৮৪৯ সালে মার্ক্স লন্ডনে যান যেখানে তিনি জীবনের বাকী সময় অতিবাহিত করেন


 দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে মার্কস ছিলেন হেগেলপন্থী ভাববাদী বার্লিনে তিনিবামপন্থী হেগেলবাদীগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন হেগেলের দর্শন থেকে নাস্তিক বিপ্লবী সিদ্ধান্ত টানার চেষ্টা করতেনলেলিন, মাকর্সবাদ, লেলিন রচনাবলি-) মার্কস নিজে মার্কসবাদী না হলেও এর তিনটি উৎসের মধ্যে এটি বিবেচিত হয় ১৯ শতকের এই জার্মান দর্শন; বাকি- ইংরেজ অর্থশাস্ত্র আর ফরাসি সমাজতন্ত্রের যুগপৎ সমন্বয়েই সৃষ্টি করে চলে মানবজাতির ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার- মানে মার্কসবাদের পথ


এখানেই সংগ্রথিত হয় মার্কসের তাবৎ প্রতিভা; তাঁর এই মতবাদ বা ভাবাদর্শের বিশ্লেষণ পদ্ধতি একই সাথে ব্যাখ্যা করে শাসক শোষকের নিজস্ব শ্রেণিচরিত্র বাস্তবিকই মার্কসীয় অর্থনীতি তখন মার্কসের নিজের মতো উদ্ভাবন করে চলে উদ্বৃত্তমূল্য তত্ত্ব; ব্যাখ্যা করে পুঁজিপতি শ্রমিক শ্রেণির মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককে শ্রমিকশ্রেণি কিভাবে পিষ্ট হয় আর ধ্বংস হয় ক্ষুদে মালিকরা এবং সেই সাথে পুঁজিপতি কিভাবে রচনা করে চলে বেকার বাহিনী সৃষ্টিপূর্বক এর হাহাকারের অর্থনীতি তাই মানবিক বিশ্বে মার্কসের রচনা নিজেই হয়ে উঠে প্রতিরোধের দর্শন বিশেষ এক অস্ত্র; যেখানে বৈষম্য-বর্তমান আর পুঁজির শোষণ অপ্রতিহত- এই মার্কসীয় বিশ্ববীক্ষার দায়িত্ব হলো সেখানে বিপ্লবী চিন্তার মধ্যদিয়ে বিপ্লবী কীর্তি আর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা


তাই বোধগম্য কারণেই বিচাররীতি হিসাবে মার্কসবাদের তুলনা হয় না এই মার্কসবাদ হলো মার্কসীয় রচনার সেই সারসংক্ষেপ যা সতীর্থ এঙ্গেলসের সঙ্গে মার্কস নিজেই একদিন রচনা করেছিলেন আত্মমুক্তির ইতিহাসে এই মার্কসবাদ তেমন হয়ে ওঠে বিপ্লবের তত্ত্ববিশেষ, তেমনি হয়ে ওঠে প্রতিরোধেরও একটা শাস্ত্রীয় পাঠ বা বিজ্ঞানের একটা দর্শন এই দর্শনচিত্র ছাড়াই শ্রমজীবী ব্যক্তিরা যখন অনুভব করে শোষণ পীড়ন থেকে মুক্তির, প্রতিবাদ প্রতিরোধ ছাড়া তখন আর কিছুই ভাবা যায় না সংকট থেকে বিকাশ ঘটে এর সমাধানসূত্রের; একইভাবে পুঁজির দৈত্য আর শোষণের চিত্র পথ দেখায় এর দাওয়াইয়ের- মার্কসীয় বিশ্লেষণের; মানবিক অর্থনীতি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের মার্কসের কৃতিত্ব হলো সাঁ সিঁমোর ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রের বিপরীতে বৈজ্ঞানিক এই সমাজতন্ত্রের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিৎ প্রতিষ্ঠা করা অবশেষে সমাধান হলো ইতিহাসের সচেতন ধাঁধাঁর


মার্কস শুধু বিপ্লবী ভাবুকই ছিলেন না; সমাজ পরিবর্তনে তিনি ছিলেন এই দর্শনের একজন ব্যবহারিক প্রতিষ্ঠাতাও ফয়েরবাখ সম্পর্কে ১১ নম্বর থিসিসে মার্কস সেটা এভাবেই সূত্রবদ্ধ করেছেন: ‘এতোদিন দার্শনিকেরা পৃথিবীকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন; তবে আসল কাজ হলো একে পরিবর্তন করামার্কস ছিলেন মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নিরাপোষ এক দরদিহৃদয়


দীর্ঘ সময় তাঁর পারিবার দারিদ্র্যতার মধ্যে জীবন-যাপন করে কিন্তু বিত্তবান এঙ্গেলস তাঁর পরিবারকে ক্রমবর্ধমান সহায়তা প্রদান করতে সমর্থ হন ধীরে ধীরে মার্ক্স তাঁর রাজনৈতিক আধ্যাত্মিক বিচ্ছিন্নতা থেকে বেরিয়ে আসেন এবং সৃষ্টি করেন তাঁর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্ম ক্যাপিটাল (Das Kapital ) বইটির প্রথম খন্ডশ্রমিক শ্রেণীর বাইবেলতাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয় বাকী খন্ডগুলো বন্ধুর মৃত্যুর পর এঙ্গেলস কতৃক সম্পাদিত [জীবনের] শেষ দিনগুলোতে মার্ক্সের স্বাস্থ সৃষ্টিশীলতা ক্ষীয়মাণ হতে থাকে তিনি বিভিন্ন স্বাস্থোদ্ধার কেন্দ্রে (Health spa) সময় কাটান ১৮৮১ সালে তাঁর স্ত্রী এক কন্যার মৃত্যু তাঁর চরম মর্মপীড়ার কারণ হয়


তিনি ১৪ মার্চ ১৮৮৩ সালে মারা যান এবং তাকে লন্ডনের হাইগেট কবরস্থানে শায়িত করা হয়