নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রথম অগ্রদূত নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী


বাংলাদেশের নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রথম অগ্রদূত লাকসামের নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী। নারী শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক বিভিন্ন কর্মকান্ডে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র মুসলিম নারী হিসেবে বৃটেনের মহারাণী ভিক্টোরিয়া কর্তৃক নওয়াব উপাদি পেলেও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি নওয়াব ফয়জুন্নেছা। মৃত্যুর ১০৯ বছরেও ফয়জুন্নেছা প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছেন।

উপমহাদেশের একমাত্র নারী নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী নারী জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। বেগম রোকেয়ার জšে§র ৪৬ বছর আগে কুমিল্লার লাকসামের পশ্চিমগাঁও এলাকায় ১৮৩৪ সালে নওয়াব ফয়জুন্নেছা জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমান সময়ে মহিয়সী নারী হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বীকৃত বেগম রোকেয়ার জন্মের সাত বছর আগে অন্ধকার যুগে নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রনায়ক নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী নারীদের জন্য উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দুঃসাহস দেখিয়েছেন।

নওয়াব ফয়জুন্নেছা ছিলেন জমিদার আহমদ আলী চৌধুরী ও আরফান্নেছা চৌধুরাণীর প্রথম কণ্যা। রক্ষণশীল সমাজে জমিদার বাড়ীর কড়া পর্দাপ্রথার মধ্যে বেড়ে ওঠা ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি বাংলা, আরবী, ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষায় বেশ পারদর্শী ছিলেন। আনুমানিক ১৮৬০-১৮৬১ সালে কুমিল্লার ভাউকসারের জমিদার মোহাম্মদ গাজীর চৌধুরীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও দু কন্যা সন্তান জন্মের পর ১৮৬৬ সালে তাদের সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়।

এরপর ফয়জুন্নেছা পশ্চিমগাঁও পিত্রালয়েই থেকে যান। জীবনের শেষ ত্রিশ বছর তিনি এখানে থেকেই নারী শিক্ষার প্রসারে অনন্য ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশে তিনিই একমাত্র নারী যিনি সর্বপ্রথম চিন্তা করেছিলেন আধুনিক শিক্ষা না পেলে নারীরা সমাজে পিছিয়ে পড়বে। তাই দুঃসাহসিক উদ্যোগ নিয়ে মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্মের সাত বছর আগে ১৮৭৩ সালে কুমিল্লা শহরের বাদুড়তলায় প্রতিষ্ঠা করেন ফয়জুন্নেছা উচ্চ ইংরেজী বালিকা বিদ্যালয়। যা বর্তমানে ফয়জুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত। ১৯০১ সালে লাকসামে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন যা বর্তমানে লাকসাম নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারী কলেজ হিসেবে পরিচিত। তিনি লাকসাম পশ্চিমগাঁওয়ে বিএন হাইস্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন। নারী স্বাস্থ্য সেবায় তিনি ১৮৯৩ সালে নবাব ফয়জুন্নেছা মহিলা ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

নবাব ফয়জুন্নেছা ১৮৯৯ সালের দেশের ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের নির্মাণ কাজে তৎকালীন সময়ে ১০ হাজার টাকা অনুদান দেন। শিশুদের শিক্ষা বিস্তারে তিনি নওয়াব ফয়জুন্নেছা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে পশ্চিমগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে চালু রয়েছে। এছাড়া দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র, পুল, ব্রীজ, কালভার্ট ও মসজিদ নির্মাণ করে একজন দক্ষ নারী নেত্রীর ভূমিকা রাখেন। বাংলার নারী ইতিহাসে নবাব ফয়জুন্নেছার দৃষ্টান্ত অতি বিরল।

শুধু শিক্ষা বিস্তারেই নয়। নওয়াব ফয়জুন্নেছা ছিলেন একজন সাহিত্যনুরাগী। তিনি ছিলেন বৃটিশ ভারতের প্রথম কবি। তাঁর রচিত রূপজালাল কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। এ কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও ফয়জুন্নেছার সঙ্গীতসার ও সঙ্গীত লহরী নামে দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুধাকর ও মুসলমান বন্ধু পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। অসাধারণ উদ্যমী ফয়জুন্নেছাকে বৃটেনের রাণী ভিক্টোরিয়া বেগম উপাধি দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ‘বেগম স্ত্রীলিঙ্গ বলেই তিনি তা গ্রহণ করেননি। পরে রাণী ভিক্টোরিয়া ১৮৮৯ সালে ফয়জুন্নেছাকে নওয়াব উপাধি দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষে খেতাব পাওয়া প্রথম মুসলিম মহিলা জমিদার।

নারী শিক্ষার প্রসারে অনন্য ভূমিকার পরও নওয়াব ফয়জুন্নেছাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা দেয়া হয়নি। বিগত ২০০৪ সালে একরকম অবহেলা ও অসম্মান করেই ফয়জুন্নেছাকে যৌথভাবে একুশে পদক দেয়া হয়। ২০০৮ সালে জাতীয় জাদুঘরে বেগম রোকেয়া ও বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের পাশে করা স্থাপন করা হয় ফয়জুন্নেছা কর্নার। স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন নির্বাচিত সরকারের আমলেও নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী তাঁর কর্মের স্বীকৃতি পাননি। আন্তর্জাতিক নারী দিবসেও অবহেলিত থেকে যাচ্ছেন ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী।

চলতি বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবর্ষে দেশের অধিকাংশ সংবাদপত্রই তাকে অবমূল্যায়ন করেছে। দেশের প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকগুলোতে শতবর্ষের ১০ সংগ্রামী নারীর ছবি ছাপা হলেও অবহেলিত থাকেন কিংবদন্তি নারী, চির সংগ্রামী নবাব ফয়জুন্নেছা। ওই ১০ জনের সঙ্গে নবাব ফয়জুন্নেছার ছবিটি যুক্ত হওয়ার শুধু যোগ্যতা নয়, অধিকারও রাখে। এ থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ইতিহাসকে বাদ দেওয়ার ফল কখনোই শুভ হয় না। তাই সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা মঙ্গলজনক। আর যিনি সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন, তাকে অবহেলা না করে সম্মান দেওয়া নিজে সম্মানিত হওয়ারই শামিল। বিষয়টি সবাই ভেবে দেখলে আগামী প্রজন্মের জন্য শিক্ষা নেওয়া বা দৃষ্টান্ত খোঁজার উপকরণ পাওয়া যাবে।

নিজ জন্মস্থান লাকসামে নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী অবমূল্যায়িত হচ্ছেন। লাকসাম নওয়াব বাড়ীটি তাঁর স্মৃতি বহন করলেও যথাযথ রক্ষণা-বেক্ষণের অভাবে বিলীনের পথে। বিভিন্ন সরকারের আমলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও এ ব্যাপারে কার্যকরী কোন প্রদক্ষেপ গ্রহণ করছেন না।

লাকসাম নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ কবির চৌধুরী বলেন- নারী শিক্ষার প্রসারে নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে উপযুক্ত সম্মান দেয়া হয়নি। আশা করি সরকার এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নিবেন।
নওয়াব ফয়জুন্নেছা ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আজাদ সরকার লিটন বলেন- নারী জাগরণের উজ্জ্বল নক্ষত্র নওয়াব ফয়জুন্নেছার জন্ম ও মৃত্যু দিবস জাতীয়ভাবে পালন করা উচিত। চালু করা যেতে পারে ফয়জুন্নেছা পদক।


 সংগৃহীত