মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?



অভিজি রায়

মার্ক্সের দর্শনে তিনটি সমকালীন ধারণার প্রভাব ছিলো।  একটি হচ্ছে হেগেল, কান্ট এবং ফয়েরনেখের জার্মান দর্শন – যা মার্ক্সকে দিয়েছিলো তার দ্বন্দিক বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তি, অন্যটি হচ্ছে উনবিংশ শতকের  ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ এবং ডেভিড রিকার্ডোর অর্থনৈতিক তত্ত্ব – যা মার্ক্সকে অনুপ্রাণিত করেছিলো  তার অর্থনৈতিক তত্ত্ব সাজাতে আর সর্বোপরি ফরাসী বিপ্লবের চিন্তাধারা তাকে দিয়েছিলো তাকে বালে দিয়েছিলো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব নির্মাণের পথ। মার্ক্স বলতেন, ‘এতদিন ধরে দার্শনিকেরা পৃথিবীকে কেবল ব্যাখ্যাই করেছেন, কিন্তু আসল কাজ হল একে পরিবর্তন করা।’ মার্ক্স তার জীবদ্দশায় পুঁজিবাদী  ব্যবস্থার আর্থসামাজিক বিন্যাস লক্ষ্য করেন।

এই পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার শোষণমূলক এবং মানবতাবিরোধী রূপ দেখে তিনি ব্যথিত হন –আর এ থেকে সাধারণ বঞ্চিত মানুষকে উদ্ধারের জন্য উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। তার জীবদ্দশায় পৃথিবীর আর্থ সামাজিক বিন্যাসের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করে মানব ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার ভিত্তি খুঁজে নেন, এবং তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের শোষণ মুক্ত সমাজ গঠনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন মার্ক্স।  মার্ক্স ধারণা করেছেন, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একদিকে যেমন শোষিত শ্রেনী নিদারূণভাবে শোষিত এবং নিপিড়ীত হবে, তেমনি তাদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে তারা যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে সামিল হবে, আর তাতে তাদের বিজয় হবে অনিবার্য। জনগন প্রবেশ করবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়।  তিনি মনে করেন এই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমগ্র উপাদন প্রক্রিয়া ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানায় পরিচালিত হবে এবং তাই এই উপাদন ব্যবস্থা থেকে যে  উদ্বৃত্ত মূল্য বা ‘সারপ্লাস’ ভ্যালু তৈরি হবে, তা সমাজের স্বার্থেই পুনর্বিয়োগ করা হবে।  এর পরবর্তী পর্যায়ে ‘বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী’ সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে, যা মানব সমাজের সর্বোচ্চ রূপ।  কার্ল  মার্ক্স তার এই চিন্তাধারাকে প্রয়োগ সম্পর্কিত দর্শন বা ‘ফিলোসফি অব প্র্যাক্টিস’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই উপলব্ধিটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান বলে অনেকেই মনে করেন।  আর সেজন্যই একটা সময় মার্ক্সের ধারণা  সারা বিশ্ব জুড়ে অগনিত চিন্তাশীল মানুষকে আকৃষ্ট করেছিলো।

মার্ক্স তত্ত্বের অনুরাগীরা ভাবতেন, এই মতবাদ এমন এক ‘সত্যের’ উপর প্রতিষ্ঠিত যা থেকে পদস্খলন কখনোই সম্ভব নয়। ঢালাওভাবে তাঁর সমস্ত বানীকে ‘বৈজ্ঞানিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো।  কিন্তু রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ এবং পরবর্তীতে সারা বিশ্বজুরে  কমিউনিস্ট বিশ্বের পতনের পর  সে সমস্ত বাণীর অভ্রান্ততা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে অনেক আগেই।  পৃথিবী জুরে পুঁজিবাদ বা ধণতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রের উত্তরোণের যে  ‘আমূল ভবিষ্যদ্বানী’ মার্ক্স করেছিলেন, আজকের বিশ্বের প্রেক্ষাপট বিশ্ল্বেষণে মনে হয় পৃথিবীর  গতি-প্রকৃতি সেভাবে যায়নি। মার্ক্স মনে করেছিলেন যে, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেনী বুঝি কেবল শোষণ আর বঞ্চনার শিকার হবে এবং এর ফলে শ্রমিক শ্রেনীর পিঠ ‘দেওয়ালে ঠেকে যাওয়ায়’ তারা ধণতান্ত্রিক সিস্টেমের পতন ত্বরান্বিত করবে।  বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জায়গায় সফলতা এলেও ধনতন্ত্রের পতন হয়নি, বরং বলা যায় ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদি ব্যবস্থা নিজস্ব সিস্টেমের দুর্বলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে বিবর্তিত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের ‘ওয়েল ফেয়ার স্টেট’ গুলো শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে আজ অনেক বেশী মনোযোগী।  বহুজাতিক কোম্পানির কর্মী বা শ্রমিকেরা আজ কোম্পানির স্টক কিনতে পারছে,  ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যমে শ্রমিকেরা নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারছে অনেক ভালভাবে - এই পুঁজিবাদী সমাজেই। তারা কিন্তু বিপ্লবের পথে যাচ্ছে না। 


মার্ক্স আরো মনে করেছিলেন পুঁজিবাদী সমাজে ‘ক্লাস পোলারাইজেশন’ তীব্র থেকে তীব্রতর হবে এবং শোষ–শোষিতের (মার্ক্সের ভাষায় বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত) মধ্যে শ্রেনীবৈষম্য প্রবলতর হয়ে উঠবে। কিন্তু আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আমরা দেখছি, নানান ধরণের সমস্যার শিকার হয়েও সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেনীর ক্রয় ক্ষমতা ও দৈনন্দিন জীবনের মান উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে এবং সর্বোপরি মালিক এবং শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে মধ্যবর্তী শ্রেণীভুক্ত মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।  বিশেষত আধুনিক বিশ্বের সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু সনাতন শ্রমিক এবং কাঁচামালের সংজ্ঞা এবং সম্পর্কই পালটে দিয়েছে।  এপ্রসঙ্গে কলকাতার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজতাত্ত্বিক ড. রামকৃষ্ণ মুখার্জির বক্তব্য প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। তিনি মনে করেন, ধণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিশীলিত রূপ গ্রহণ করার ফলে শ্রমশক্তির এক উল্লেখযোগ্য অংশ কায়িক শ্রম দানের পরিবর্তে বুদ্ধিজনিত শ্রমদান (মেন্টাল লেবার) করছে এবং তারাই মধ্যবিত্তসূলভ জীবন জাপন করছে।  প্রতিবছরই তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে এইচ ওয়ান ভিসায় আমেরিকায় আসছে আজার হাজার ‘মেন্টাল লেবারের’ দল, যারা তৈরি করেছে এক দৃশ্যমান বলিষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেনী।   বলা বাহুল্য, এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীর বুদ্ধিমত্তা ও মানসিকতা আপামোর জনগণের কাছে সাধারণ মানদন্ড হিসেবে পরিগণিত হয়েছে এবং সমাজে তাদের আধিপত্য বিস্তৃত হবার মধ্য দিয়ে তাদের স্বার্থ অনুযায়ী সামাজিক কাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে। মার্ক্সের সনাতন ধারণায় সমগ্র উপাদিকা শক্তিকে কেবলমাত্র কায়িক শ্রমদানকারী শ্রমিকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করেছিলেন – যা আজকের দুনিয়ার সাপেক্ষে অনেকটাই বাতিলযোগ্য।

এ ছাড়া মনে রাখতে হবে, শুধু শ্রেনীগত কিংবা অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়, আজকের দুনিয়ার জটিল সমাজে আরো নানা ধরণের দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত (যেমন, জাতিগত, লৈঙ্গিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক কিংবা ধর্মীয় সঙ্ঘাতের কথা বলা যায়) রয়েছে যা পৃথিবীর গতিপথ নির্ধারণে অনেক সময়ই নিয়ামক ভুমিকা পালন করেছে – মার্ক্স সেগুলো তেমন গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেননি, তার তত্ত্বে তিনি শুধু ‘ক্লাস কনফ্লিক্ট’কেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

শ্রেনী সঙ্ঘাতের উপস্থিতি রয়েছে, প্রবলভাবেই রয়েছে কিন্তু শুধু শ্রেনীগত দ্বন্দ্ব দিয়ে দুনিয়ার সবকিছুকে ব্যখ্যা করাকে আধুনিক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা এখন ‘অতি সরলীকরণ’ কিংবা ‘অসম্পূর্ণ’ বলেই মনে করেন। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভারতে শ্রেণীবিভাগের তাপর্য’ শীর্ষক লেখায় মন্তব্য করেছিলেন,
শ্রেণী ছাড়াও আসলে অসাম্যের অনেক উ আছে; অসুবিধা আর বৈষম্যের সমস্ত কিছু কেবলমাত্র শ্রেনী দ্বারাই নির্ধারিত হবে – এই ধারণা ত্যাগ করতে হবে’। 

মার্ক্সের তত্ত্বের বিরুদ্ধে এটি একটি গুরুতর অভিযোগ সবসময়ই।  যখন মার্ক্সের অনুরাগীরা দেখলেন পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি মার্ক্সের দেখানো পথে যাচ্ছে না, তখন তাদের দরকার ছিল এই তত্ত্বকে বাতিল করে নতুন তত্ত্বের খোঁজ করা। তা না করে তারা পুরোন তত্ত্বকেই তারা আঁকড়ে ধরে রইলেন, এবং তত্ত্বকে জোড়া তালি দিয়ে একধরণের যথার্থতা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। পপারের মতে এ ধরণের কর্মকান্ড বিজ্ঞানমনস্কতার পরিপন্থি।  সত্যি বলতে কি, এ ধরনের মনোভাবই তৈরি করে অন্ধ স্তাবকের এবং একটি তত্ত্বকে ঠেলে দেয় বিজ্ঞান থেকে অপবিজ্ঞানের দিকে 

লুইস ফুয়ের, বার্ট্রান্ড রাসেল, গিবন প্রমুখ দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী, এবং ঐতিহাসিকেরা সময় সময় দেখিয়েছেন  মার্ক্সের তত্ত্বের সাথে বিজ্ঞানের চেয়ে ধর্মের সাযুজ্যই বেশী।  যে ভাবে কমিউনিজম সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল তা ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত ঈশ্বর কর্তৃক পরকালে স্বর্গের স্বপ্নময় আবেদনের কথা মনে করিয়ে দেয়।  ধার্মিকরা যেমন কোরান, বেদ, বাইবেল, হাদিস প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের মধ্যে মহাসত্য খুঁজে পান, এবং মুহম্মদ, যীশু এবং অন্যান্য ধর্মপ্রচারকদের বানীকে শিরোধার্য করে রাখেন, এবং তাদের দেখানো পথেই নিজেদের চালিত করতে চান- ঠিক সেভাবেই  কমিউনিস্টরা অনেকটা মার্ক্স, লেলিন, স্ট্যালিন, ট্রটস্কি, মাও এবং তাদের লেখা লাল বইগুলোকে দেখতেন।

ধর্মের অনুসারীরা যেভাবে নিজ নিজ ধর্ম প্রতিষ্ঠার নামে ঢালাওভাবে বিধর্মীদের উপর অত্যাচার করেছে, ঠিক তেমনি কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা এবং বিপ্লবেরর নামেও লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, গুলাগে প্রেরণ করা হয়েছে অনেক প্রগতিশীল মানুষকে, ‘শ্রেনীশত্রু’ কিংবা ‘পুঁজিবাদের দালালের’ তকমা এঁটে নির্যাতন করা হয়েছে কিংবা  পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে।  বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিক এবং রাজনীতিবিদদের নির্যাতন, নির্বাসন, কারাগারে নিক্ষেপ, শ্রমশিবিরে প্রেরণ, মস্তিস্ক ধোলাই ইত্যাদি সেই মধ্যযূগীয় ধর্মের কৃষ্ণ ইতিহাস ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।  ‘কাফের নিধন’, কিংবা ‘নির্যবন করো সকল ভুবন’-এর মত ‘বুর্জোয়াদের খতম কর’ ধ্বনি দিয়ে শ্রেনীহীন সমাজ গড়বার প্রেরণা ছিলো কমিউনিজমের অপরিহার্য শ্লোগান। ক্রুসেড, জ্বিহাদ ধর্মযুদ্ধের মতই ছিলো তাদের এই শ্রেনীসংগ্রামের লড়াই।  লেলিনের সময় আমাদের ‘র‌্যাব’ বা ‘রক্ষীবাহিনীর’ মত যে বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী CHEKA গঠন করা হয়েছিলো, যার ফলশ্রুতিতে ১৯২৩ সালের মধ্যে বলি হয়ছিলো ৫ লক্ষ লোক। এই হত্যা আর নির্যাতন আরো প্রকট আকার ধারণ করে স্ট্যালিনের জামানায়।  ‘কুলাক’ নামে একটি সম্ভ্রান্ত কৃষক শ্রেনীকে  ‘শ্রেনী শত্রু’ হিসবে আখ্যায়িত করে পুরোপুরি  নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়।  এক সন্দেহবাতিকগ্রস্ত প্রবল ক্ষমতাশালী স্বৈরশাসকে পরিনত হন স্ট্যালিন। রাস্তা ঘাট শহর বন্দরের নাম স্ট্যালিনের নামে নামাঙ্কিত করা হয়। রাস্তায় রাস্তায় গড়ে তোলা হয় বিশাল বিশাল স্ট্যালিনের মূর্তি। চারিদিকে কেবল ‘পশ্চিমা চর’ আর ‘বুর্জোয়া দালাল’ খুঁজে ফিরতেন স্ট্যালিন। নিজের সামান্য সমালোচনাও সহ্য করতেন না তিনি। যে কোন জায়গায় কারো ব্যর্থতা মানেই তার কাছে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’।  নির্দয়ভাবে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতেন তিনি একের পর এক।  তার এই সীমাহীন নিপিড়ন, নির্যাতন আর অত্যাচারের সময়টুকু (১৯৩৬-১৯৩৯) আজ ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে আছে  ‘দ্য গ্রেট টেরর’ (The Great Terror) হিসেবে।  একই ধরনের ধর-পাকড়, নির্যতন-নিপীড়ন আর হত্যাকান্ড চলেছিলো চীনে ‘চ্যায়ারম্যান মাও’ এর শাসনামলেও।  পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে (১৯৫৮) তথাকথিত ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ (Great Leap Forward) –এর সময় মাওয়ের নানা ধরনের অপ্রমাণিত এবং অবৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারনা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার শিকার হয়ে চীনের কৃষিক্ষেত্রের বারোটা বেজে যায়। ফলে ১৯৫৯ সালে সারা চীনে শতকরা পনের ভাগ ফসল ঘাটতি দেখা দেয়, ১৯৬০ সালে আরো দশ ভাগ ঘাটতি, ১৯৬১ তেও অবস্থা তথৈবচ। সারা চীন জুরে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। চীনের ‘সরকারী হিসেবে’ই দুর্ভিক্ষে মৃত্যু সংখ্যা উল্লেখ করা হয়  এক কোটি চল্লিশ লাখ।  বেসরকারী হিসেবে দুই কোটি থেকে প্রায় চার কোটির কাছাকাছি বলে বিভিন্ন গবেষোনাপত্রে উল্লেখ করা হয়। সমগ্র মানবেতিহাসেই সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এটি। 

লীও শাওকি, দেং জিয়াও পিয়াং, লীন বিয়াও এবং মাওএর স্ত্রী জিয়াং চিং-এর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে প্রাণ হারায় লক্ষ লক্ষ লোক। এই লখো মানুষের মৃত্যুকে মাওয়ের শাসনামলে মহিমান্বিত করা হয়েছিলো ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’-এর ধুঁয়া তুলে।

'The Black Book of Communism' বইয়ের পরিসংখ্যানে উল্লিখিত হয়েছে যে, সোভিয়েত ইউনিয়নে ২ কোটি লোক, সাড়ে ৬ কোটি লোক চীনে, ১০ লাখ লোখ ভিয়েতনামে, ২০ লাখ লোক উত্তর কোরিয়ায়, ২০ লাখ লোক কম্বোডিয়ায়, ১০ লাখ লোক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে, দেড় লাখ লোক পূর্ব ইউরোপে, ১৭ লাখ লোক আফ্রিকায়, ১৫ লাখ লোক আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসনামলে নিহত হয়। এছাড়া ক্ষমতার বাইরে থাকা 'সর্বহারা বাহিনী', 'নকশাল' টাইপের দলগুলোর কমিউনিস্ট মুভমেন্টে সাড়া দুনিয়া জুড়ে মারা গেছে অন্ততঃ ১০ হাজার মানুষ। গণহত্যার গবেষক রুমেলের মতে সোভিয়েত রাশিয়া প্রায় ছয় কোটি লোককে কমিউনিজমের নামে হত্যা এবং নির্যাতন করা হয়েছিলো, চীনে ১৯৪৯ সাল থেকে ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবের’ সময় দশ লক্ষ লোক নিহত হয়েছিল। কম্বোডিয়ায়  পলপটের সৈন্যবাহিনীর হাতে চার বছরে নিহত হয় প্রায় বিশ লক্ষ লোক। এ সমস্ত গবেষকের সঠিক সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা যেতে পারে সহজেই কিন্তু তারপরও বলা যায়, একটি ‘বৈজ্ঞানিক’ সমাজব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য ঢালাওভাবে এত মানুষের প্রাণহানি কেন ঘটাতে হবে সে প্রশ্ন উত্থাপন মোটেই অসমীচীন নয়। আসলে ‘কমিউনিজম  নিজেই একটি ধর্ম’ কিনা ঢালাওভাবে এ বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়  এর মধ্যে ধর্মের উপাদান রয়ে গেছে, প্রচ্ছন্নভাবেই।